সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ১০:১৮ পূর্বাহ্ন

খুলনার রূপসা চরের আঁখি’র চোখে মানব কল্যাণের স্বপ্ন

এস.এম. সাঈদুর রহমান সোহেল, খুলনা ব্যুরো::

আঁখি। বয়স ১৭। খুলনার রূপসা চরের বাসিন্দা। বাবা মাসুদ মোল্লা অসুস্থ্য। আর মা আনোয়ারা বেগম মাছ কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করেন। এ দম্পত্তির তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে আঁখি দ্বিতীয়। খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামের চরের এই কিশোরী আঁখি’র বড় স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্ব দরবারে। তিনি জাতিসংঘের ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ খেতাব পেয়েছেন।

এর আগে বিশ্ব মানবিক দিবস উপলক্ষে ১৯ আগস্ট জাতিসংঘ আঁখিসহ বাংলাদেশের চারজনকে ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। মূলত : চলমান করোনার শুরুতে মাস্ক তৈরি করে স্বল্প মূল্যে বিক্রি ও দরিদ্রদের মধ্যে ফ্রি বিতরণের স্বীকৃতি হিসেবেই এ খেতাব মিলেছে তার।

এদিকে, ছোট্ট আঁখির বড় স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে খুশির আমেজ বিরাজ করছে তার দরিদ্র পরিবারে। বিবিসি থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তার স্বাক্ষাতকার এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে অভিনন্দন জানানোসহ তার স্বপ্ন পূরণের আশ্বাসে আঁখিকে নিয়ে গর্বিত তার বাবা-মা।
আঁখির চোখে-মুখে এখন মানুষের কল্যাণে কাজ করার স্বপ্ন। ভালো সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে ভবিষ্যতে সে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও ঝরেপড়া দরিদ্র শিশুদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ সেন্টার করার ইচ্ছা পোষণ করেছে। খুলনা রূপসা ঘাটপার হয়ে ডান দিকে (পূর্ব রূপসা) বীরশ্রেষ্ট রুহুল আমিন সড়ক। এ সড়ক দিয়ে ১ কিলোমিটার পর আব্দর রব মোড়। সেখান থেকে বাঁদিকে ১শ’ গজ গিয়ে আবার বাঁয়ে ১শ’ গজ। ইটের রাস্তা। এবার ডানে দিকে কয়েক গজ যেতেই দেখা যাবে ছোট্ট একটা দোকানে মাস্ক, বিভিন্ন হস্ত শিল্পের জিনিষপত্র, রয়েছে ছোটদের খাবার। এ দোকানে বসে বেঁচাকেনা করেন আঁখি’র বাবা শারীরিক ভাবে অক্ষম মাসুদ মোল্লা। এক সময় মাছ কোম্পানিতে (চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা) কাজ করতেন তিনি। তার মা আনোয়ারা বেগম এখনও মাছ কোম্পানিতে কাজ করেন। বাবা-মা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে আঁখিরা তার খালার জমিতে বসবাস করেন। যেখানে কোন রকমের মাথা গোজার ঠাঁই তৈরি করে।

জানা গেছে, আঁখি স্থানীয় বামগারা দক্ষিণ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ালেখা করেছে। কিন্তু অভাবের তাড়নায় ৪-৫ বছর আগে সেও বড় বোনের সাথে মাছ কোম্পানিতে কাজ নেয়। পরে ‘ওয়াল্ড ভিশন বাংলাদেশ’র ‘জীবনের জন্য প্রকল্প’ ধেকে দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে সেলাই কাজ করে সংসারে রোজগার বাড়াতে থাকে আঁখি।

আঁখি জানান, যখন করোনা ভাইরাস শুরু হয়েছিল। বাজারে মাস্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খুঁজে পাওয়া গেলেও দাম ছিল অনেক। আমাদের এলাকার দরিদ্র লোকেরা তা কিনতে পারতোনা। তখন আমি নিজেই মাস্ক তৈরি করে কম দামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেই। যাতে এলাকার গরীব মানুষসহ সবাই মাস্ক পরতে পারে। আবার যারা কিনতে পারে না তাদের মধ্যে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করি। ওয়াল্ড ভিশন থেকে পাওয়া দর্জি কাজের প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন দিয়েই আমি এ কাজ করতে সক্ষম হই।

আঁখি তার ভবিষ্যৎ স্বপ্নের বিষয়ে বলেন, ভালো সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে ভবিষ্যতে তিনি একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গড়ে তুলতে চান। একই সঙ্গে তার মত ঝরেপড়া দরিদ্র শিশুদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান। তার ইচ্ছা পূরণের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য (খুলনা-৪, রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া), সাবেক ফুটবলার ও শিল্পপতি আব্দুস সালাম মূর্শেদী প্রতিনিধি পাঠিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলেও জানান আঁখি।
ছোট্ট আখিঁর বিশ^ব্যাপি স্বীকৃতিতে অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে মা আনোয়ারা বেগম বলেন, বস্তিতে থেকে আমার মেয়ে এমন সুনাম আনবে আমি ভাবতেও পারিনি। ওর (আঁখি) বাবা অনেক অসুস্থ। তেমন একটা হাটতে-চলতে পারে না। আমিও মাছ কোম্পানিতে কাজ করি। আঁখি যেন ভবিষ্যতে দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করতে পারে- এ আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ সাউদার্ন রিজিওনের রিজিওনাল কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর সুবর্ন চিসিম জানান, ২০১৮ সালে রূপসার একটা চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় আঁখি’র সন্ধান মেলে। তাকে আমরা স্কুলে ভর্তি করার উদ্যোগ নেই। কিন্তু তার বয়স বেশী হওয়ায় তাকে ভর্তি করা যায়নি। কিন্তু তার আগ্রহ দেখে ‘জীবনের জন্য প্রকল্প’র মাধ্যমে তাকে সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করি। প্রশিক্ষণ শেষে আঁখিকে সেলাই মেশিন ও কিছু থান কাপড় দেওয়া হয়। সে এই করোনা মহামারিকালে মাস্ক তৈরি করে কম দামে গরীব লোকদের কাছে বিক্রি করেছে। অনেককে বিনামূল্যে মাস্ক দিয়েছে। জাতিসংঘ তার এই মহৎ কাজের স্বীকৃতি দদেয়ায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।

এ বিষয়ে রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন আক্তার বলেন, রূপসা চরের আঁখি এখন রূপসা তথা খুলনাবাসীর গর্ব। এ কারণে তাকে আজ বুধবার (২৬ আগস্ট) উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। এছাড়া তার ইচ্ছা পূরণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের সাধ্যের মধ্যে সবকিছু করা হবে।

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ কর্তৃক ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত বাংলাদেশের অন্য তিন যুবক হলেন, প্রাক্তন ডাকসু সদস্য তানবীর হাসান শৈকত, ব্র্যাকের প্রকৌশলী রিজভী হাসান এবং অনুবাদক সিফাত নূর।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com